আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের শাসনকালে কখনো মুক্তিযোদ্ধা সন্তান কমান্ড, আবার কখনো বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটের নেতা পরিচয় দিতেন তিনি। বাউল সেজে গাইতেন শেখ মুজিবুর রহমান আর শেখ হাসিনার গান। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগের পতনের পর ভোল পাল্টে নাম লিখিয়েছেন ভূঁইফোড় সংগঠন জাতীয়তাবাদী বাউল দলে।

সুনামগঞ্জে বহুল আলোচিত আল হেলাল মো. ইকবাল মাহমুদ নামের ওই ব্যক্তি জুলাই আন্দোলনে আহত সেজে সরকারি অনুদান গ্রহণ করে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। অনুদান বাগিয়ে নিতে আহত হওয়ার ভূয়া কাগজপত্র তৈরির অকাট্য তথ্য প্রমাণ মিলেছে তার বিরুদ্ধে।

জানা যায়, গত ১০ মে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ২৩২ জন ‘সি’ ক্যাটাগরির আহতকে এক লাখ টাকা করে অনুদান দেয় জুলাই ফাউন্ডেশন। আহত না হয়েও ভূয়া কাগজপত্র তৈরি করে এই তালিকায় কয়েকজন অনুসারীসহ নাম যুক্ত করে নেন বিগত সরকারের সুবিধাভোগী আল হেলাল।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গেল বছরের ৪ আগস্ট শেখ হাসিনার পদত্যাগের একদফা দাবির আন্দোলনে সুনামগঞ্জে প্রতিবাদী ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি আর টিআরসেল ছুড়ে বহু আন্দোলকারীকে আহত করে পুলিশ। আওয়ামী ক্যাডারদের ইটপাটকেল ও লাঠিপেটায়ও আহত হন অনেকে।

একাধিক সূত্র জানায়, সংঘর্ষের দিন আল হেলাল ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও আহত তালিকায় নাম তোলার নানা ফন্দি ফিকির আঁটতে থাকেন। আহত হওয়ার প্রমাণপত্র হিসেবে চোখে টিআর সেলের আঘাত পেয়েছেন বলে জুলাই ফাউন্ডেশনে ভূয়া একটি ব্যবস্থাপত্র দাখিল করেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আল হেলালকে যে চিকিৎসক ব্যবস্থাপত্রটি দিয়েছেন, তাঁর নাম মো. আজিজুল হক। তিনি রোগী দেখতেন শহরের আধুনিক চক্ষু হাসপাতালে।

ডা. আজিজুল হক বলেন, '৪ আগস্ট নয়, সেপ্টেম্বরে হাসপাতালের চেয়ারম্যানকে সঙ্গে নিয়ে পুরাতন তারিখ দেখিয়ে একটি ব্যবস্থাপত্র নিতে তার কাছে আসেন আল হেলাল। অনুরোধ করেন, এই ব্যবস্থাপত্রটি দিলে তিনি সরকার থেকে কিছু আর্থিক অনুদান পাবেন।'

ওই চিকিৎসক দাবি করেন, 'ব্যাক ডেইটে আমি ব্যবস্থাপত্র দিতে রাজি হইনি। পরে চেয়ারম্যানের চাপে ব্যবস্থাপত্র দিতে বাধ্য হই। চেয়ারম্যান নিজে উপস্থিত থেকে আমাকে দিয়ে এই ভূয়া ব্যবস্থাপত্র করাতে বাধ্য করছেন। ৪ আগস্ট আল হেলাল আমার নিকট থেকে কোনও চিকিৎসা নেননি।'

হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, 'চিকিৎসকের সঙ্গে যোগসাজস করে এই ব্যবস্থাপত্র হয়তো আল হেলাল সংগ্রহ করেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ যেসকল রোগী দেখে তাদের নাম রেজিস্টারে লিপিবন্ধ থাকে। ৪ আগস্ট উনার নাম আমাদের রেজিস্টারে লিপিবদ্ধ নেই।'

হাসপাতালের ব্যবস্থাপক মো. দুলাল মিয়া বলেন, 'গত বছরের ৪ আগস্ট আমাদের রেকর্ডপত্র অনুযায়ী আল হেলাল মো. ইকবাল মাহমুদ নামের কোনো রোগী আমাদের হাসপাতালে চিকিৎসা নেননি। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে হয়তো ডাক্তারের কাছ থেকে ব্যবস্থাপত্র হাসিল করে নিয়েছেন তিনি। এখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই।'

অভিযুক্ত আল হেলাল মোহাম্মদ ইকবাল মাহমুদ বলেন, '৪ আগস্ট টিয়ারশেলের ধোঁয়ায় আমার চোখে সমস্যা হয়েছে। ওই দিনই আধুনিক চক্ষু হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছি। অনুদান বাগাতে আমি কোনও প্রকার প্রতারণার আশ্রয় নেইনি।'

এদিকে, ভূয়া জুলাই আহত সেজে সরকারি অনুদান সংগ্রহ করার বিষয়টি জানাজানি হওয়ায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় জুলাই গণঅভ্যুত্থানে আহতসহ আন্দোলনের পক্ষের মানুষের মাঝে। তারা বিষয়টির নিরপেক্ষ তদন্ত দাবি করেন।

আন্দোলনে আহত শিক্ষার্থী নাইম আহমদ অন্তর বলেন, 'কেউ যদি অসৎ পন্থা ব্যবহার করে আহত তালিকায় নাম তোলে অনুদান নেন, সেটা ঘোরতর অন্যায়। বিষয়টি তদন্ত করে খতিয়ে দেখা জরুরি।'

অপরদিকে, ভূয়া আহত সেজে জুলাই ফাউন্ডেশনের অনুদান গ্রহণের অভিযোগের পর অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রেজাউল করিমকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এই কমিটি তদন্তে সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে বলে জানা গেছে।

জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া বলেন, 'অনুদান নিয়ে যে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে, তার প্রেক্ষিতে গঠিত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখানে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে জুলাই ফাউন্ডেশনে অনুদানের টাকা ফেরত দিতে হবে। পাশাপাশি তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।'

(মূল রিপোর্ট : (সংগ্রহীত আমার দেশ)