সিলেট জেলা বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একটি ঐতিহাসিক ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর অঞ্চল। এটি সিলেট বিভাগের অধীনে এবং এর আয়তন প্রায় ৩,৪৫২ বর্গকিলোমিটার ।
ভৌগোলিক অবস্থান ও সীমা
সিলেট জেলার উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের খাসিয়া ও জৈন্তিয়া পাহাড়, দক্ষিণে মৌলভীবাজার, পূর্বে ভারতের কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলা এবং পশ্চিমে সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা অবস্থিত।
জনসংখ্যা ও জাতিগোষ্ঠী
২০২২ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, সিলেট জেলার জনসংখ্যা প্রায় ৩৮.৫ লাখ। এখানে মণিপুরি, খাসিয়া, পাত্র, ত্রিপুরা, সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে।
প্রাকৃতিক সম্পদ ও পর্যটন
সিলেট প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর—জাফলং, বিছানাকান্দি, রাতারগুল, লালাখাল, জৈন্তাপুর পাহাড়, ভোলাগঞ্জের পাথরের স্তূপ ইত্যাদি পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এছাড়া এখানে রয়েছে প্রাকৃতিক গ্যাস, পাথর ও বালির বিশাল মজুদ।
প্রশাসনিক কাঠামো
সিলেট জেলায় রয়েছে ১৩টি উপজেলা, ১৭টি থানা, ১০৬টি ইউনিয়ন এবং ১টি সিটি কর্পোরেশন।
শিক্ষা ও প্রতিষ্ঠান
এখানে রয়েছে ৭টি বিশ্ববিদ্যালয়, ৪৪টি কলেজ, ৩১৬টি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, ১৯৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ১৭৬টি মাদ্রাসা। এছাড়া রয়েছে মেডিকেল কলেজ, আইন কলেজ, ক্যাডেট কলেজসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান।
ঐতিহাসিক গুরুত্ব
সিলেট ১৭৭২ সালে জেলা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধে এ জেলার অবদান ছিল অসামান্য—মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম এ জি ওসমানী ছিলেন এই জেলারই কৃতী সন্তান।
চা-বাগান, প্রবাসী অর্থনীতি, প্রাকৃতিক সম্পদ আর ঐতিহ্যে ভরপুর সিলেট সত্যিই এক অনন্য জেলা।
সিলেটের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য এক কথায় বলা যায়—বৈচিত্র্য ও গভীরতায় ভরপুর। এই অঞ্চলের ইতিহাস, ভাষা, ধর্মীয় বিশ্বাস, লোকসংগীত, পোশাক, খাবার এবং জীবনধারা সবকিছুতেই রয়েছে এক অনন্য স্বাতন্ত্র্য।
ভাষা ও লোকসংস্কৃতি
সিলেটি ভাষা বাংলা ভাষার একটি স্বতন্ত্র উপভাষা, যার নিজস্ব ধ্বনি ও শব্দভাণ্ডার রয়েছে। এই ভাষায় গান, গল্প, প্রবাদ-প্রবচন ও হাস্যরসের চমৎকার ভাণ্ডার গড়ে উঠেছে। সিলেটি নাটক ও পালাগানও লোকজ সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
ধর্মীয় ঐতিহ্য
সিলেটকে বলা হয় “৩৬০ আউলিয়ার দেশ”। হযরত শাহ জালাল (রহ.) ও তাঁর সফরসঙ্গীদের আগমনের মাধ্যমে ইসলাম এখানে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তাঁদের স্মৃতিবিজড়িত মাজার ও ধর্মীয় স্থানগুলো আজও পূণ্যভূমি হিসেবে বিবেচিত।
সংগীত ও নৃত্য
সিলেটের লোকসংগীতে রয়েছে বাউল, মারফতি, মুর্শিদি ও ধামাইল গান। ধামাইল নৃত্য বিশেষ করে নারীদের মধ্যে জনপ্রিয়, যা বিয়ের অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়। মণিপুরি সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যবাহী নৃত্যও সিলেটের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে রঙ যোগ করেছে।
খাবার ও রান্না
সিলেটি খাবারে রয়েছে ঝাল ও মসলার আধিক্য। “সাতকরা” দিয়ে রান্না করা গরুর মাংস, “শুঁটকি ভর্তা”, “চিংড়ি মালাইকারি” এবং “চা” এখানকার বিশেষত্ব। সিলেটের চা-বাগানগুলো শুধু অর্থনীতিই নয়, সংস্কৃতিরও অংশ।
পোশাক ও হস্তশিল্প
সিলেটের ঐতিহ্যবাহী পোশাকে রয়েছে মণিপুরি তাঁতের শাড়ি ও গামছা। এখানকার হস্তশিল্প, বাঁশ ও বেতের তৈরি সামগ্রী, এবং মাটির পাত্রও বেশ জনপ্রিয়।
স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শন
শাহ জালাল (রহ.) ও শাহ পরান (রহ.)-এর মাজার, জৈন্তাপুর রাজবাড়ি, এবং বিভিন্ন প্রাচীন মসজিদ ও মন্দির সিলেটের ইতিহাস ও ধর্মীয় সহাবস্থানের সাক্ষ্য বহন করে।
সিলেটের সংস্কৃতি যেন এক মোহময়ী কাব্য—যেখানে ইতিহাস, ধর্ম, প্রকৃতি ও মানুষের জীবনধারা একসাথে মিশে গেছে।