সুনামগঞ্জে ৯০টি ভারতীয় গরু অদৃশ্য হওয়ার ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রেজাউল করিমকে দায়ী করে তদন্ত কমিটির কাছে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।
সুনামগঞ্জ প্রেসক্লাবের সদস্য ও দৈনিক খবরপত্র প্রতিনিধি হোসাইন মাহমুদ শাহীনসহ ৮জন সাংবাদিক বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট ) পর্যন্ত তদন্ত কমিটির আহবায়ক কাস্টমস,এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সিলেট এর কমিশনার রেজভী আহাম্মেদ এবং একই বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলা বিভাগীয় কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব সহকারী কমিশনার গৌরব মহাজনের কাছে এ অভিযোগগুলো দায়ের করেন।
গত ১২মে কাস্টমস,এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট সিলেট এর ০৮.০১.৬০০০.০১৭.৩৪.০০৩.০৭ (অংশ-১)/২৪৬৮ নং স্মারকাদেশ মোতাবেক জনৈক আব্দুল আলী নামের এক ব্যক্তির দায়েরকৃত অভিযোগের ভিত্তিতে সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের বিরুদ্ধে ৪ সদস্য বিশিষ্ট উক্ত তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
দায়েরকৃত অভিযোগে সাংবাদিকরা বলেন,গত ৩০ এপ্রিল আমরা সুনামগঞ্জ শহরে কর্মরত প্রায় ২০ জন সাংবাদিক ঘটনার সময় জেলার আব্দুজ জহুর সেতুতে অবস্থান করে,নদীপথে ৯০টি ভারতীয় চোরাই গরু পাচার করা হইতেছে দেখে স্বউদ্যোগী হয়ে বিজিবি সুনামগঞ্জকে একের পর এক মোবাইল কল করত: সংবাদ দেই।
আমাদের মোবাইল ফোনের সংবাদে বিজিবি সুনামগঞ্জ সদর উপজেলার গৌরারং ইউনিয়নের অচিন্তপুর গ্রামের সামনে সুরমা নদীতে নৌকাসহ ৯০টি গরু আটক করে ব্যাটালিয়নের হেডকোয়ার্টারে আটককৃত নৌকাসহ ৯০টি গরু নিয়ে যায়। আটককৃত গরুগুলোর ব্যাপারে সদর উপজেলা প্রাণীসম্পদ কর্মকর্তা ডাঃ অমিত সাহা,এগুলো ভারতের মেঘালয় এলাকার গরু বলে লিখিত মতামত ব্যক্ত করেন।
এরপর আমরা সাংবাদিকরা সুনামগঞ্জ বিজিবির মল্লিকপুরস্থ হেডকোয়ার্টারে সরজমিনে গিয়ে আটককৃত গরুগুলোর ভিডিও ধারন করি। এসময় সাংবাদিকরা ও উপস্থিত কাস্টমস কর্মকর্তা কাস্টমস আইন ও বিধি অনুযায়ী গরুগুলো নিলাম দেওয়ার জন্য বলার পরও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুনামগঞ্জ (এডিএম) মোহাম্মদ রেজাউল করিমের দোহাই দিয়ে ৫ জন ব্যবসায়ী বিজিবির মল্লিকপুরস্থ হেডকোয়ার্টারে অনধিকার প্রবেশ করে
সাংবাদিকদের সাথে বাকবিতন্ডায় লিপ্ত হয়। পরবর্তীতে আমরা জানতে পারি অনধিকার প্রবেশকারী ঐ ৫জন লোক ভারতীয় গরুর চোরাকারবারী। এডিএম মোহাম্মদ রেজাউল করিম,ক্ষমতার অপব্যবহার ও প্রচলিত কাস্টমস আইনকে উপেক্ষা করে ঐ ৫ জন লোকের কাছে একে অপরের যোগসাজশে তার পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে আটককৃত ভারতীয় গরুগুলো নির্বাহী ম্যাজিট্টেট মেহেদী হাসান হৃদয় কে প্রেরণ করে উপস্থিত সকল সংস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে গরুগুলো তাদের জিম্মায় দিতে বিজিবিকে বাধ্য করেছেন। ঐদিন তিনি জেলা সদরে ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসকের ও চোরাচালান বিরোধী টাস্কফোর্সের সভাপতিরও দায়িত্বে ছিলেন।
জিম্মা গ্রহনকারীরা ঐ গরুগুলো এডিএম রেজাউল করিমের আশ্রয় প্রশ্রয়ে ও পরোক্ষ সহযোগীতায় কালোবাজারে বিক্রয় করেছে মর্মে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়। সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানায় তদন্তাধীন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই আল আমিন সরজমিনে গিয়ে ৯০টি ভারতীয় গরু জিম্মাদারদের কাছে না পেয়ে গত ১০ জুন বিজ্ঞ আদালতকে লিখিতভাবে অবগত করেন। পরবর্তীতে ভারতীয় গরু পাচারের বিষয়টি ধামাচাপা দিতে এডিএম মোহাম্মদ রেজাউল করিম কথিত ৫ জিম্মাদারকে যেকোন মূল্যে ৯০টি গরু তাদের হেফাজতে পুনরায় সংগ্রহের নির্দেশ দিলে উক্ত জিম্মাদাররা দেশী বিদেশী আরো ৯০টি গরু সংগ্রহ করে।
কিন্তু পরবর্তীতে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা,বিজিবি,কাস্টমস এর কর্মকর্তা ও সাংবাদিকরা জিম্মাদারদের জিম্মায় নেয়া পূর্বের গরুর মধ্যে মাত্র ১৪টি ভারতীয় গরুর কোনরকম মিল পেলেও বাকী গরুগুলো পূর্বের আটককৃত ও জিম্মায় দেয়া গরুর সাথে মিলেনা বলে জানিয়েছেন এবং মতামত ব্যক্ত করেছেন।
সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার এসআই বর্তমান তদন্ত কর্মকর্তা মিজানুর রহমান বলেন,বিজিবির উপস্থাপন মতে ৯০টি গরুর মধ্যে পূর্বের গরুর সাথে মাত্র ১৪টি গরুর মিল পাওয়া গেছে মর্মে গত ২৮ জুলাই বিজ্ঞ আদালতে আমি একটি প্রতিবেদন দাখিল করেছি।
গরু চুরির বিষয়টি ধামাচাপা দিতে এবং বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন মামলাকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করতে জাল জালিয়াতির আশ্রয় গ্রহন করা হচ্ছে বলেও দুদকের কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে জানতে পেরেছেন। গত ২৯ জুলাই কাস্টমস বরাবরে সাংবাদিকদের নাম ঠিকানা উল্লেখসহ সাংবাদিক হোসাইন মাহমুদ শাহীন একটি লিখিত অভিযোগ দায়ের করেছেন।
সদাশয় সরকারের ৭০ লক্ষ টাকা রাজস্বের ক্ষতিসাধন এবং কাস্টমস আইন অমান্য করে জিম্মদার নাটকের মাধ্যমে ভারতীয় গরু পাচারে সহায়তার সুনির্দিষ্ট অভিযোগে এডিএম রেজাউল করিমের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ কামনা করেন অভিযোগকারী সাংবাদিকবৃন্দ। জানা যায়,এডিএম রেজাউল করিম ২০২৩ সালের ৮ ফেব্রæয়ারি সুনামগঞ্জে এডিসি হিসেবে যোগদান করেন। এরপর থেকে আওয়ামীলীগের মন্ত্রী,এমপি ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানসহ তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের সাথে তার ব্যক্তিগত দহরম মহরম গড়ে উঠে।
স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালকের দায়িত্বে থেকে হাঠবাজারের গরু বিক্রেতাদের সাথে গড়ে উঠে তার অন্যরকম সম্পর্ক।
জিম্মাদার হারুন রশিদ বলেন, গরুগুলো বিভিন্ন স্থানে আছে। আমার গুলোও আমার কাছে নেই।
কোথায় আছে জানতে চাইলে তিনি বলেন,বিভিন্ন স্থানে আছে। অপর জিম্মাদার নাজমুল হাসান বলেন,আমার গরুগুলোও আমার কাছে নাই। এগুলো বাঁশতলা এলাকায় আছে। তাহলে পুলিশ কেন খুঁজে পেলনা জানতে চাইলে তিনি বলেন,পুলিশের সঙ্গে ভুল বুঝাবুঝি হয়েছে। আমি এ নিয়ে চরম পেইনের মধ্যে আছি। পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা আল আমিন বলেন, আমি সুনামগঞ্জ সদর থানা থেকে বদলি হয়ে এসেছি।
তবে এর আগে আমি ঘটনাস্থলে গিয়েছিলাম। গরুগুলো জিম্মাদারদের কাছে পাইনি। এসংক্রান্ত প্রতিবেদন আমি আদালতে জমা দিয়ে এসেছি। বর্তমানে এসআই মিজান মামলাটির তদন্তের দায়িত্বে রয়েছেন।
সুনামগঞ্জ-২৮ বিজিবির অধিনায়ক লে.কর্নেল জাকারিয়া কাদির বলেন, ৯০টি গরু টাস্কফোর্স কমান্ডার ৫ জনকে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন,এখন পুলিশ সরেজমিন তদন্ত করে জানতে পেরেছে এগুলো জিম্মাদারের কাছে নেই। এ বিষয়ে পুলিশের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা আদালতে প্রতিবেদন জমা দিয়েছেন।
আদালত এখন এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে টাস্কফোর্স কমান্ডার লিখিত নিয়েই ৫ জনের জিম্মায় গরুগুলো দিয়েছিলেন বলে জানান তিনি। সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও ওই ঘটনার টাস্কফোর্স কমান্ডার মেহেদি হাসান হৃদয় ইতিপূর্বে সাংবাদিকদের বলেন,আমি বিজিবিকে নিয়মিত মামলা করার নির্দেশ দিয়ে গরুগুলো ৫ জনের জিম্মায় দিয়েছিলাম। এগুলো রাখার এখতিয়ার
আমাদের নেই। এ বিষয়ে আদালতই সিদ্ধান্ত নিবেন। সুনামগঞ্জ জেলা সদরে শত শত গরু বিক্রেতা ও খামারী থাকার পরও দোয়ারাবাজারের সীমান্ত হাটের ব্যবসায়ীদের কাছে কার নির্দেশে জিম্মায় দিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। জেলা প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন,যে ম্যাজিস্ট্রেট গরুগুলো জিম্মায় দিয়েছেন এবং যে কর্মচারী কথিত জিম্মানামায় স্বাক্ষর করেছেন তাদের উভয়কেই বিজিবির হেডকোয়ার্টারে প্রেরণ করেছেন এডিএম রেজাউল করিম। সুতরাং জিম্মা নাটকের মাধ্যমে ভারতীয় গরু আড়াল করার ঘটনার দায় তিনি কোনভাবেই এড়িয়ে যেতে পারেননা।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন,এটা কোর্টের বিষয় কোর্ট দেখবে। আপনি নিউজ করবেন,করেন। যা লেখবার লেখেন। এ বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই। এ প্রতিবেদক উপরোক্ত লিখিত সংবাদটি দেখে বক্তব্য প্রদানের জন্য অনুরোধ জানিয়ে তার ওয়াটসআপে প্রেরণ করতে চাইলে তিনি বলেন,এসব আমাকে পাঠানোর প্রয়োজন নেই। যা বুঝবার কোর্ট বুঝবে।
সর্বশেষ খবরে জানা যায়,সুনামগঞ্জ সদর মডেল থানার মামলা নং ০২ (জিআর ১২৬/২০২৫) তাং ৪/৫/২০২৫ইং এর মাধ্যমে জিম্মা নাটকের অবসান ঘটাতে আগামী ২৬ আগস্ট বিকাল সাড়ে ৪টায় চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এর কার্যালয়স্থিত নিলাম কমিটির আহবায়কের এজলাস কক্ষে প্রকাশ্য নিলামে বিক্রয় করা হবে ৯০টি গরু।
আগ্রহী ক্রেতাগনকে যথাসময়ে উপস্থিত থেকে ৯০টি ডেকা ষাড় গরু ক্রয়ের জন্য ১০ লক্ষ টাকা জামানত হিসেবে সংশ্লিষ্ট আদালতের নেজারত বিভাগের রুপালী ব্যাংক শাখার অনুকূলে ১৯৩৩০২৪০০০০২৩ নং হিসেবে পে-অর্ডারের মাধ্যমে টাকা জমা দিতে বলা হয়েছে। গত ১০/০৮/২০২৫ইং তারিখে ৩৮২ নং স্মারকে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের বিচারক ও সিজেএম কোর্টের নিলাম সংক্রান্ত কমিটির আহবায়ক মুহাং হেলাল উদ্দিন উক্ত নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রদানের মাধ্যমে বিজ্ঞ আদালতের আদেশ জারী করেন।
কাস্টমস,এক্সাইজ ও ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয়ের সুনামগঞ্জ জেলা কর্মকর্তা ও তদন্ত কমিটির সদস্য সচিব সহকারী কমিশনার গৌরব মহাজন বলেন,আমরা বারবার বলে আসছি ভারতীয় গরু নিলামের এখতিয়ার শুধুমাত্র কাস্টমস আইনে কাস্টমস কর্তৃপক্ষসহ চোরাচালান বিরোধী টাস্কফোর্সের হাতেই ন্যস্ত রয়েছে। আমরা বিধি মোতাবেক জেলা প্রশাসন,বিজিবি,ডিজিএফআই ও এনএসআই প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে প্রকাশ্য দিবালোকে নিলাম করার আইনগত অধিকার রাখি।
৩০ এপ্রিলের জব্দকৃত গরুগুলো ঐসময়ই নিলাম করার কথা। কিন্তু জেলা প্রশাসন কাস্টমস আইন ও বিধিবিধান অনুসরণ না করায় ৪ মাস পরে নিলাম দেওয়ার কথা উঠেছে। তাছাড়া পূর্বের ৯০টি ভারতীয় গরুর মধ্যে বর্তমানে আছে ১৪টি। বাকি ৭৬টি ভেজাল গরু সংগ্রহ করে জাল জালিয়াতির আশ্রয় যারা গ্রহন করেছে তাদেরকে চিহ্নিত করার দায়িত্ব সুনামগঞ্জবাসীকে নিতে হবে বলে আমি মনে করি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে পূর্বের জব্দকৃত ৯০ টি ভারতীয় গরুর মধ্যে যেখানে পুলিশের তদন্ত রিপোর্ট মতে ৭৬টি গরু এখনও বাস্তবে নেই সেই ৭৬টি গরুর দায়িত্ব কে নেবে। এছাড়া বিজিবি হেডকোয়ার্টারে হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও যেসব চোরাকারবারীদের আটক বা গ্রেফতার করা হয়নি এমনকি আসামী করা হয়নি মামলার সেই ৫ জিম্মাদারের কবল থেকে ৭৬টি গরু উদ্ধারের কোনরকম প্রচেষ্টা কি আদৌ আইন শৃঙ্খলা বাহিনী নেবে সেই প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে সচেতন নাগরিকদের মধ্যে। বিষয়টি শেষ পর্যন্ত কোনদিকে মোড় নেয় সেদিকে দৃষ্টি এখন সকলের।
হোসাইন মাহমুদ শাহীন
সুনামগঞ্জ
তা : ২৩/৮/২০২৫ইং
মোবাইল : ০১৭১৬-৪৬৯৫০৬