দলটির ভাষ্য🖊
সরকারের ছত্রছায়ায় গঠিত দল নির্বাচনে এলে সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। শেখ হাসিনার বিদায় হলেও প্রশাসনসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় দোসররা বহাল। কিছু ক্ষেত্রে রদবদল করা হলেও ঘুরেফিরে তারাই পুনর্বাসিত হচ্ছে। এদের রেখে অবাধ-সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে হলে অবশ্যই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে কারণে বিএনপি শুরু থেকেই ক্ষমতাচ্যুত সরকারের সুবিধাভোগী আমলাদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে,
বিএনপি শুরু থেকেই বলে আসছিল, এই সরকার ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সরকার। একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে তারা এই সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করবে। সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, বেশকিছু বিষয়ে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার নিরপেক্ষতা পালন করতে পারছে না। মূলত সরকারে প্রতিনিধি রেখে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্যোগ এবং প্রশাসনে এখনো আওয়ামী ফ্যাসিবাদের আশীর্বাদপুষ্টরা বহাল থাকায় সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে এই প্রশ্ন তুলেছে বিএনপি। দলটির বক্তব্য হচ্ছে, ছাত্র আন্দোলনের তিনজন প্রতিনিধি এই সরকারে রয়েছেন। সুতরাং সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করলে নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার আনার প্রয়োজন হবে।
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে আত্মপ্রকাশ করতে যাচ্ছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল। ছাত্রদের এই নতুন দল গঠনের উদ্যোগকে স্বাগত জানালেও বিএনপির শঙ্কা, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই দল গঠিত হতে যাচ্ছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকারের ছত্রছায়ায় যদি কোনো দল হয় এবং সেই দল যদি নির্বাচনে আসে, তাহলে তো সরকার নিরপেক্ষতা হারাবে। তা ছাড়া বিএনপির অভিযোগ, ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিদায় হলেও প্রশাসনসহ রাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এখনো তার দোসররা বহাল রয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে রদবদল করা হলেও ঘুরেফিরে তারাই পুনর্বাসিত হচ্ছে। তাদের প্রশাসনে রেখে অবাধ-সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। দলটি মনে করে, নিরপেক্ষ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন হতে হলে প্রশাসনকে অবশ্যই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সে কারণে বিএনপি শুরু থেকেই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী আমলাদের সরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু তাদের এখনো সরানো হয়নি বলে দাবি দলটির নেতাদের।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু গতকাল কালবেলাকে বলেন, এই সরকারের প্রধানতম কাজ হচ্ছে দ্রুততম সময়ে একটি অবাধ-সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করা এবং সেই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তা ছাড়া গত ১৬-১৭ বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত জনগণও এখন ভোট দিতে উন্মুখ হয়ে রয়েছে। তারা তো সরকারকে দল বানাতে বলেনি।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এমন প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নাম প্রস্তাব করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। তাদের এই প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে ড. ইউনূস তখন গণমাধ্যমকে জানান, ‘যে শিক্ষার্থীরা এত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তারা যখন এই কঠিন সময়ে আমাকে এগিয়ে আসার অনুরোধ করেন, তখন আমি কীভাবে তা প্রত্যাখ্যান করি?’ এরপর ৮ আগস্ট ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। এই সরকারে ছাত্রদের তিনজন প্রতিনিধিও আছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, এই সরকার ছাত্রদের সরকার, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমর্থিত সরকার। সুতরাং ছাত্রদের কোনো দাবি কিংবা বক্তব্য স্বাভাবিকভাবেই সরকারের ওপর গিয়ে বর্তায় বলে অভিমত তাদের।
এদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিগত আওয়ামী সরকার রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ করে ধ্বংস করে ফেলেছে। এ অবস্থায় নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব নয়। এ জন্য রাষ্ট্রকাঠামোর প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার। এ লক্ষ্যে একাধিক সংস্কার কমিশন গঠন করে সরকার। শুরু থেকেই সরকারকে সার্বিক সহযোগিতার কথা জানায় বিএনপি। তারা সরকারকে নির্বাচনমুখী প্রয়োজনীয় সংস্কার কার্যক্রম শেষে দ্রুততম সময়ে নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানায়। তাদের অভিমত, সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। নির্বাচিত পরবর্তী সরকার সংস্কার কার্যক্রমকে এগিয়ে নেবে। তবে ‘শুধু নির্বাচনের জন্য গণঅভ্যুত্থান হয়নি’—সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের দু-একজন উপদেষ্টার এমন বক্তব্যকে ভালোভাবে নেয়নি বিএনপি।
তা ছাড়া ছাত্রদের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণের দাবি, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র প্রণয়ন এবং বাহাত্তরের সংবিধান বাতিলের দাবি জানানো হয়। বিএনপি শুরু থেকেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে কোনো বিরোধে না জড়ানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সে কারণে বিএনপিকে নিয়ে ছাত্রদের নানা সমালোচনামূলক বক্তব্যেও তারা সরাসরি কোনো প্রতিক্রিয়া দেখায়নি। কিন্তু রাষ্ট্রপতি অপসারণ, ঘোষণাপত্র ও সংবিধান ইস্যুতে ছাত্রদের সঙ্গে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়। সর্বশেষ ছাত্রদের নতুন দল গঠনের উদ্যোগকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে বিএনপি।
গত মঙ্গলবার একটি বিদেশি গণমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারে নিজেদের প্রতিনিধি রেখে ছাত্ররা রাজনৈতিক দল গঠন করলে নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকার আনার প্রয়োজন হবে। তিনি বলেন, সরকারে থেকে কেউ নির্বাচন করতে চাইলে অন্য রাজনৈতিক দলগুলো তা মেনে নেবে না। বিএনপি মহাসচিব বলেন, যদি সরকার পূর্ণ নিরপেক্ষতা পালন করে, তাহলেই তারা নির্বাচন পরিচালনা করা পর্যন্ত থাকবেন। তা না হলে নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন হবে।
গতকাল রাজধানীতে এক আলোচনা সভায় মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচন যদি দ্রুত না হয়, সময়ক্ষেপণ করা হয়, তাহলে অন্য শক্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। সুতরাং সরকারকে ন্যূনতম যে সংস্কার আছে, সেই সংস্কারগুলো করে দ্রুত নির্বাচনের পথে যাওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, আমরা যারা রাজনীতি করি, তারা বদলানোর চেষ্টা করি, কিন্তু দেখা যায় সবসময় আমরা পেরে উঠি না। কারণ, প্রতিক্রিয়াশীল যে চক্র আছে, সেই চক্র এতবেশি দৃঢ় হয়ে যায় যে, বিপ্লবের বা সংগ্রামের সেই ধারাকে তারা বদলে দিতে চায়।
এদিকে বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যকে কঠোরভাবে নিয়েছে এই সরকার। মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নিরপেক্ষ সরকারের দাবি মূলত আরেকটি এক-এগারো সরকার গঠনের ইঙ্গিত বহন করে বলে মন্তব্য করেন তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় এবং ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। গতকাল বিকেলে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি এ কথা বলেন।
অন্যদিকে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের অনেক প্রস্তাবকে ‘অপ্রয়োজনীয়’ বলে মনে করছে বিএনপি। দলটির নেতারা বলছেন, এ ধরনের সংস্কার প্রস্তাব জটিলতা বাড়াবে। তাই সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবনা নিয়ে শিগগির সরকারের সঙ্গে বৈঠক আশা করছে বিএনপি। একই সঙ্গে সরকারের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের ঘোষণাপত্র তৈরির যে উদ্যোগ, এতদিন পরে এসে সেটাও ‘সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক’ বলে মনে করছেন তারা। দলটি মনে করে, এই মুহূর্তে এটার কোনো দরকার নেই। রাজনৈতিক মতৈক্য না হলে এটি এক ধরনের বিতর্ক-বিশৃঙ্খলা তৈরি করতে পারে।